মোহাম্মদ আশরাফুল আলম
পিছন থেকে ডাক, স্যার-স্যার-স্যার! ফিরিয়ে দেখি, বোরখা পরিহিত, মুখ ঢাকা, চেনার উপায় নেই। বললাম, আরে মা, তোমাকে চিনব কিভাবে? সঙ্গে সঙ্গে মুখের পর্দা সরিয়ে বলল, আমি ডাক্তার। আপনি তো আমার বাবার মত, দীর্ঘদিন মেমসহ আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে আজ এই সেবা করার যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন।
আমি একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক। বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে প্রকৃতিকে অনুধাবন করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাবার সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজনে ওয়ার্ড হতে বাইরে ছুটছি। বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞান প্রতিনিয়তই নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের ভেতর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতাকে। কিন্তু সরকারি মেডিকেলে পরীক্ষা নিরীক্ষা…………?
Excuse me, sir. আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি আপনার বাবাকে একটু দেখতে চাই। সত্যি সত্যি ওই মুহূর্তে চোখ হতে নিজের অজান্তে অশ্রু পড়ছিল। সেদিন মনে হল আমার শিক্ষকতা জীবন সার্থক, আমি ধন্য, আমি গর্বিত।
Teachery is a Noble job. হাজার খানের শিক্ষক কে তো পদত্যাগ করানো হলো। শত কোটি টাকা লুটপাটকারি কয়টা আমলাকে পদত্যাগ করানো হলো এ পর্যন্ত? এখানে কারো বৈঠা খাটবে না। নোবেল প্রফেশন গুলোর পিছনে লেগেছে অনেকেই। এখন লেগেছে ডাক্তারদের পিছনে। জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর সময় স্টোক করা সেই অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম স্যার ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শুধু জোর পূর্বক নয়, টেনে -হেচড়ে,কলম ধরিয়ে বা ষড়যন্ত্র করে বা অপসারণের অপচেষ্টা একটি জাতির জন্য কতই না লজ্জাস কর!
শিক্ষা হল প্রত্যাশিত আচরণ। ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রত্যাশিত আচরণ শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের আচরণের প্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটায়। জনমুখী উন্নয়ন ও গতিতে নেতৃত্ব দানের উপযোগী মনন শীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের ও অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমত সহনশীলতা, অসাম্প্রদায়িক এবং দেশ প্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলে শিক্ষাব্যবস্থা।
পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একটি সুপরিকল্পিত বিজ্ঞানমনস্ক মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের সক্ষম শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক যা রণ কৌশল হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু জাতির জন্য দুর্ভাগ্য অদ্যাবধি বাংলাদেশের কোন শিক্ষা কমিশন গৃহীত শিক্ষা নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দলীয় সরকারের লেজুড়বৃত্তিক হিসেবে শিক্ষা নীতিতে ব্যবহার করা হয়। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষকেরা জাতি গঠনের কারিগর। অথচ সেই শিক্ষক ই আজ লাঞ্ছিত, অপমানিত, অপদস্ত। অবিলম্বে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও চর দখলের লড়াই বন্ধ করা হোক।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর পথে চলার সংগ্রাম সুদৃঢ় থাকুক। শিক্ষার্থীদেরকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসাবে গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশে সহায়তা প্রদানে সহায়ক শিক্ষা নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা লাভের সমান সুযোগ সুবিধা অবারিত করা হোক। শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। শিক্ষার সকল স্তরের শ্রমের প্রতি শিক্ষার্থীদেরকে শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তোলা এবং স্তর বিশেষে আত্ম কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হওয়ার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা হোক।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করানো নয় বরং অনেক ব্যাপক। মানবতার কল্যাণ সাধন ও পরিবর্তিত বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যোগ্য নাগরিক তৈরি করা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকতে হয় গণ রুমে যেখানে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে লেখাপড়া করতে হয়। অভিভাবক সহ ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, ওই সময়টুকু নাকি ইনজয় করার মত। পরস্পরের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, যে স্মৃতিটুকু ভোলার মতো নয়। খুব ভালো কথা কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মী যখন মেধাবীদেরকে শাসন করে রুম থেকে বের করে দেয়, নিজেদের বাহিনী নিয়ে ভোগ দখল করে বিলাসবহুল গাড়ি বাড়ি নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষক তাদেরকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল, করে গলা ফাটায়, তখনই শুরু হয় মেধাবীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে স্বৈর শাসকের। আশার আলো জাগে জনমনে।
হাজারো ছাত্রের রক্তের বিনিময়ে শৃংখল মুক্ত হন বেগম খালেদা জিয়া সহ অনেক ত্যাগী নেতা কর্মী। বেরিয়ে আসে আয়না ঘরের নিষ্ঠুরতার নির্মম কাহিনী। পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। দেশের শুরু হলো বন্যা। ফেরাউনের পতনের পর ৪০ দিনের বন্যায় দেশ ধুয়ে মুচেপবিত্র হয়ে উঠেছিল স্বৈরশ শাসকের পতনে পর যত অন্যায় অবিচার চিরতরে নিমজ্জিত হোক গভীর সমুদ্রের নিষ্ঠুর নির্মমতায়।
society is the Complex of major groups and institution. এখানে যে কেউ যে কোন অপরাধ করতে পারে। DGFI, NSI, CID এর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে অপরাধীরা অপরাধ জগৎ হতে ফিরে আসবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।
আমরা বাঙালি। আমাদের অনেক ইতিহাস আছে। একুশ দেখিনি, ৬৯, দেখিনি ৭১, দেখিনি। দেখেছি ৫ ই আগস্ট ২০২৪। ছাত্র-জনতার মিছিলে শুধু রাজপথ কানায় কানায় ভরে উঠেনি বরং শত শত মানুষ ছাদে দাঁড়িয়ে কেউবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ জাগিয়েছে,উদ্দীপনা দিয়েছে। ছাত্র জনতার, গন অদ্ভুত্থান হতে রাজনীতিবিদদের এতটুকু শিক্ষা হওয়া উচিত যে, পাপ নিজের বাপকেও ছাড়ে না।
একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতি নির্ভর করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক মানের ওপর। বিশ্ব বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তাই নৈতিক মানের উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সমাজে সমাজের প্রতি তার দর্শন ছিল (virtue). অর্থাৎ সৎ গুনাবলী অর্জনের ওপর। জ্ঞান, আত্মবিশ্বাস, উচচ নৈতিকতাবোধ একটি সমাজকে মানবিক ও সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে, জীবন কে করতে পারে প্রকৃত অর্থে অর্থবহ। প্রবাদ আছে, Charity begins at home.
সৎ গুণাবলী অর্জন পরিবার হতে শুরু করতে হবে। শিক্ষার সকল স্তরে জ্ঞানের প্রয়োগ করাতে হবে বাস্তব ভাবে। কর্ম জীবনে সাফল্য শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য নয়, অনেক বৃহৎ, মানবতার সেবা ও কল্যাণ সাধন এবং পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সুনাগরিক গড়ে তোলা। তাই আসুন, চিন্তা, কর্ম, আচরণ মানবিক হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সততা, দেশপ্রেম, ন্যায় নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠায় সকলেই সচেষ্ট হই। পরিশেষে বঙ্কিমের উক্তি দিয়ে ইতি টানলাম, ” ঘটনাধীনে চিত্ত সংযম করেন মহাত্মা। কেউবা আপন চিত্ত সংযম করে না, তাহারই জন্য বিষবৃক্ষের বিষ উপ্ত হয়। অবিচ্ছিন্ন সুখ, দুঃখের মূল ; পূর্ব গামী দুঃখ ব্যতীত স্থায়ী সুখ জন্মে না। (লেখক: অধ্যক্ষ, লালকুঠি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, ধাপ, মহানগর, রংপুর।)