ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, লালমনিরহাট॥ গেল দশ বছরে তিস্তা নদীর ভাঙনে দশ বিঘা আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে চরম দারদ্রিতার সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন নরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৭৫)। তিস্তাপাড়ে বসে নীরবে কাঁদেন তিনি। একসময়ের সচ্ছল নরেন্দ্রের কপালে এখন ঠিকমতো খাবারও জোটে না। তার চার ছেলে মহানন্দ বর্মণ, নিরানন্দ বর্মণ, ভবেশ বর্মণ ও শ্রীধর বর্মণ বসবাস করছেন আলাদা সংসারে। তারা সকলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর ঘর নির্মাণ করে কোনরকমে বসবাস করছেন। নরেন্দ্র আশ্রয় নিয়েছেন শ্রীধর বর্মণের সংসারে আর তার স্ত্রী পূর্ণ বালা আশ্রয় নিয়েছেন ভবেশ বর্মণের সংসারে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তারপাড়া রাজপুর গ্রামের নরেন্দ্র বর্মণের মতোই ভাঙনকবলিত পরিবারের মানুষজনকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নরেন্দ্র নাথ বর্মণ বলেন, স্বাধীনতার পর তাদের ১০০ বিঘা জমি ছিলো। তিনি ভাগ পেয়েছিলেন ২৫ বিঘা জমি। দশ বছর আগেও দশ বিঘা জমি ছিলো। এখন আর কিছুই নেই। সবকিছুই চলে গেছে তিস্তা নদীর উদরে। একসময় আমার বাড়ি অনেক পরিবারের খাবার যোগাতো। এখন আমার কপালে খাবার জোটে না। প্রায়ই আমাকে অর্ধাহারে থাকতে হয়।
নরেন্দ্রের ছেলে শ্রীধর বর্মণ (৪৪)বলেন, তিস্তা নদীর ভাঙন তাদের স্বপ্ন ও আশা কেড়ে নিয়েছে। আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের ওপর। বসতভিটার জন্য কয়েক শতাংশ জমি কেনার জন্য গেল আট বছর চেষ্টা করছেন কিন্তু সামর্থ্য তৈরি করতে পারছেন না। এখন গ্রামে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে আয় করে সংসার চালাচ্ছেন। অভাবের কারনে আমাদের তিন ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা করাতে পারছি না।
নরেন্দ্রের প্রতিবেশি গাদলী বালা (৭০), জোসনা বালা (৭২) ও সুরেন চন্দ্র রায় (৭৫)। তারা তিস্তা নদীর ভাঙনকবলিত। তারা সকলে গেল ৯ বছরধরে বসবাস করছেন সরকারি রাস্তার। গাদলী বালাল সংসারে ১২ বিঘা জমি ছিলো। জোসনা বালার ছিলো ৯ বিঘা জমি আর সুরেনের ছিলো ১৫ বিঘা জমি। তাদের সকলের বসতভিটা ছিলো। ফলের বাগান ছিলো। এখন আর কিছুই নেই। তাদের বসতভিটা ও আবাদি জমি এখন তিস্তার উদরে। তারা এখন বসবাস করছেন জীর্ণশীর্ণ ঘরে। জীবিকার তাগিদে মাঝে মাঝে তাদেরকে ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয়। তিস্তার ভাঙন তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কেড়ে নিয়ে ভিক্ষুক বানিয়েছে।
গাদলী বালা বলেন, ৯ বছর আগে নদী ভাঙনে সবকিছু হারালে তার দুই ছেলে গজেন বর্মণ ও ভুপেন বর্মণ পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। তিনি সরকারি রাস্তার ওপর একটি ঘর তুলে বসবাস করছেন। নদীভাঙনে সবকিছু হারানোর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আট বছর আগে তার স্বামী বিনোদ বর্মণ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। তিনি আরো বলেন, এক সময় আমাদের সুখি সংসার ছিলো। এখন দু:খ ছাড়া আমার কপালে কিছুই নেই। খাবারের জন্য আমাকে এখন লড়াই করতে হচ্ছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার ফলিমারী গ্রামের ভাঙনকবলিত বকতিয়ার রহমান (৬৫)বলেন, গেল ৫-৬ ভছরে গ্রামের ৩০০টি পরিবার ভাঙনকবলিত হয়ে ্খন মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছে। ধরলা নদীর উদরে বিলীন হয়েছে গ্রামের প্রায় ৩০০ একর আবাদি জমি। আমরা চরম দারিদ্রতার সাথে লড়াই করছি। আমাদের পুনর্বাসনের কথা কেউ ভাবছে না।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্ণা গ্রামের ভাঙনকবলিত নজরুল ইসলাম (৫৬) বলেন, গ্রামের ৮০টি পরিবার এখন আলাদা আলাদা বসবাস করছে। গের ৩-৪ বছরে তিস্তার ভাঙনে সবগুলো পরিবার বসতভিটা ও আবাদি জমি হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। অনেকে সরকার রাস্তার ওপর ঘর নির্মাণ করে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। গ্রামের প্রায় দেড়শ একরের বেশি জমি এখন তিস্তা নদীর উদরে রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও শিক্ষা অফিস সুত্র জানায়, গেল দশ বছরে তিস্তা ও ধরলাপাড়ে ভাঙনকবলিত হয়েছে ১২,৫০০ পরিবার। পুনর্বাসনের জন্য ভাঙনকবলিত প্রত্যেক পরিবার দেওয়া হয়েছে দুই বান্ডেল টিন ও নগদ ৫ হাজার টাকা। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৯ হাজারের বেশি একর আবাদি জমি। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্বাসন করা হয়েছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর ৮০ শতাংশই কৃষি পরিবার। জেলার ৪৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ২২টি ইউনিয়ন ভাঙনকবলিত।
হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান বলেন, গেল দশ বছরে তার ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার পরিবার তিস্তা নদীর ভাঙনকবলিত হয়েছে। প্রত্যেক পরিবার হারিয়েছে ৪-১০ বিঘা আবাদি জমি। এসব ভাঙনকবলিত পরিবারের অধিকাংশই অন্যত্রে চলে গেছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলো সরকারি রাস্তা ও বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়ে মানবেতরভাবে বসবাস করছে। কিছু ভাঙনকবলিত পরিবার পুনর্বাসনের সরকারি সহায়তা পেয়েছে তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর মানুষজনকে প্রতিক্ষণ সঙগ্রাম করেই বাঁচতে হচ্ছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বলেন, গেল দশ বছরে তার ইউনিয়নে প্রায় ৯০০ পরিবার ধরলা নদীর ভাঙনকবলিত হয়েছে। তারা বসতভিটা ও আবাদি জমি হারিয়ে বাঁধ ও সরকারি রাস্তার ওপর বসবাস করছেন। ভাঙনকবলিত প্রত্যেক পরিবারকে পুনর্বাসন করতে সরকারিভাবে দুই বান্ডেল টিন ও নগদ ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ভানকবলিত অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর দু:খের শেষ নেই।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন মোফা বলেন, তার ইউনিয়নের ৭০ শতাংশ মানুষ দারদ্রিতার সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তার ইউনিয়নে দারিদ্রতার কারন হলো তিস্তার নদীর ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে বসতভিটা, আবাদি জমি ও ফলের বাগান হারিয়ে বিত্তশালীরা এখন চরম দাদ্রিতার সাথে লড়াই করছেন। অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। গেল দশ বছরে তার ইউনিয়নের ৫ হাজারের বেশি পরিবার ভাঙনকবলিত হয়েছে। অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্রে। ভাঙনকবলিতদের পুনর্বাসন করতে সরকারিভাবে এখনো তেমন কোন উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়নি। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার বলেন, জেলায় তিস্তা ও ধরলাপাড়ে ২০-২২টি পয়েন্টে প্রতিবছর ভাঙন দেখা দেয়। কোন কোন পয়েন্টে ভাঙন তীব্র আকার ধার করে। বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিযন্ত্রণ বাঁধ ও নদী তীর ভাঙনরোধে গেল ১০ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়ে থাকে কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাট জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, নদীভাঙনে বাস্তুহারা মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। নদীপাড়ের মানুষজন গরীব হয়ে যাওয়ার প্রধান কারন নদীভাঙন। নদী খনন ও তীর সংরক্ষণ করা না হলে নদীভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার পরিবারকে সবকিছু হারিয়ে দরিদ্র হতে হবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী নদী ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে সহায়তা করা হয়। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলো সরকারি আাবাসন প্রকল্পের ঘরে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ভাঙনকবলিতদের পুনর্বাসন করতে স্থায়ী পদক্ষপ নিতে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পত্র দেওয়া হয়েছে।