কুড়িগ্রাম ব্যুরো॥ ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানের পরও কুড়িগ্রামে বেপরোয়াভাবে চলছে অবৈধ ইটভাটা। অভিযান চালিয়ে জরিমানা সহ অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিলেও মালিকপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিযানে বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার কয়েকদিনের মাথায় আবারও প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ করে’ অবৈধ ইটভাটাগুলো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম চালু থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে।
স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে অবৈধ ভাটা বন্ধের নির্দেশ দিলেও ভাটা মালিকরা কয়েকদিন বাদে আবারও তা চালু করছে। প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্র সেগুলো আবারও বন্ধ করা হচ্ছে। ‘ম্যানেজ করার’ অভিযোগ সঠিক নয়।
কুড়িগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে কুড়িগ্রামে মোট ১০৮ টি ইটভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হয়। এসব ভাটার মধ্যে ৭২ টি ইটভাটা অবৈধ। জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে অভিযানে ভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত ১ মার্চ পর্যন্ত চলতি মৌসুমে জেলায় ৬১ টি ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ৪১ টি অবৈধ ভাটার কার্যাক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বন্ধ করে দেওয়া হলেও প্রায় সবগুলোই আবার চালু করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের আজোয়াটারী এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেসার্স এম এস এইচ ব্রিকস, মেসার্স এ বি ব্রিকস, মেসার্স ডব্লিউ এ এইচ ব্রিকস, মেসার্স জে এম এস ব্রিকস এবং মেসার্স আলতাফ ব্রিকস নামে ৫ টি অবৈধ ইটভাটার কিলন ভেঙে দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয় ভ্রাম্যমান আদালত। ভাটাগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে রাজারহাটের সিন্দুরমতিতে অবস্থিত মেসার্স ডি কে ব্রিকস নামক ইটভাটা বন্ধ করে দেয় ভ্রাম্যমান আদালত। বর্তমানে সেই ভাটাটি আবারও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ২৯ জানুয়ারি একই মালিকের একই নামে সদরের টগরাইহাটে অবস্থিত ইটভাটায় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমান আদালত। ভাটার আগুন নিভিয়ে কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। কয়েকদিনের বিরতি দিয়ে বর্তমানে ইট ভাটাটি চলমান রয়েছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরীর নিলুরখামার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেসার্স ডি এ ব্রিকস নামে ইটভাটার আগুন নিভিয়ে ভাটাটির কার্যক্রম সম্পুর্ণ বন্ধ করে দেয় ভ্রাম্যমান আদালত। কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই আবারও চালু হয় ভাটাটি। অবৈধ ওই ভাটাটিতে এখনও ইট পোড়ানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলায় ৯ উপজেলাতেই অভিযানে বন্ধ করে দেওয়া অবৈধ ইটভাটাগুলো আবারও চালু করেছেন মালিকরা। নিয়মিত ইট পোড়ানো হচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ইটভাটার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। ইট পুড়িয়ে তা বিক্রিও চলছে। অভিযানের পরও এসব ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিযান ও জরিমানা করার কয়েকদিনের মাথায় আবারও ইটভাটার কার্যক্রম শুরু হওয়া প্রমাণ করে ভাটা মালিকরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছেন। এক্ষেত্রে পরিবেশের কী ক্ষতি হলো কিংবা আদালত কী বললো তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
ফুলবাড়ীর আজোয়াটারী গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, ‘ প্রশাসন অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার পরও তা চালু হয় কীভাবে। নিশ্চয় পরে প্রশাসনকে ম্যানেজ করা হয়। ইটভাটাতো গোপনে চলে না। অভিযানে যদি ভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হতো তাহলে আবার চালু হতো না।
রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণ কমিটির জেলা শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন দায়সাড়া অভিযান চালায়। কখনও কখনও ম্যানেজ করা হয়ে থাকে। ফলে আবারও ইটভাটার কার্যক্রম চলে। অভিযানে জরিমানার পাশাপাশি অবৈধ ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে এই প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে।’
অভিযান পরিচালনার পরও অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম চালু থাকার বিষয়ে জানতে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রেহেনুমা তারান্নুমকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আল ইমরান বলেন, উপজেলায় দুটি ইটভাটা অবৈধ। দুটোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
উপজেলার সিন্দুরমতি এলাকায় এখনও একটি অবৈধ ইটভাটা চলমান থাকার তথ্য জানালে ইউএনও বলেন, তাহলে তারা আবারও চালু করেছে। আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।
তবে ইটভাটা মালিকরা বলছেন, মৌসুমের মাঝপথে প্রশাসনের অভিযানে তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আদালতের দেওয়া এক মাসের সময়ের মধ্যে তারা ভাটা শেষ করতে চান।
জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ভাটার কিলনের ভিতর ইট। মাঠে ইট। এ অবস্থায় ভাটা বন্ধ করলে মালিকরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। এছাড়াও ভাটা সরিয়ে জমিগুলো স্বাভাবিক করার জন্য ইট সরানো প্রয়োজন। এজন্য মালিকরা ইট পুড়িয়ে ভাটা বন্ধ করে দেবেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী বছর থেকে আর ভাটা চালু করা হবে না। আদালত যে এক মাস সময় দিয়েছে সেই সময়ের মধ্যে আমরা ভাটার কার্যক্রম শেষ করবো।
কুড়িগ্রাম পরিবেশ অধিপ্তরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, সীমিত সাধ্যের মধ্যে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার পর আবারও চালু করছে। আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, প্রশাসনকে ম্যানেজ করার বিষয়টি সঠিক নয়। অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরে আবার চালু করে থাকলে সেটা আমাদের জানার কথা নয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণেরও এগিয়ে আসতে হবে। প্রশাসন এককভাবে সব করতে পারবে না। তারপরও আমি ইউএনওদের বলবো আবারও ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে। প্রয়োজনে এসব অবৈধ ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।