মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগমন ও তিরোধানের সাথে সংশ্লিষ্ট মাসটি হলো আজকের রবিউল আউয়াল মাস। তাই এই মাসটি বিশ্বের মানুষের কাছে একই সাথে আনন্দের এবং বেদনারও মাস।
মহানবী (সাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ ৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহন করেন। আব্দুল্লাহর ২৪ বছর ৭ মাস বয়সে মদীনার স্বনামধন্য সওদাগর ওয়াহাবের কন্যা আমিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আব্দুল্লাহ ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। ‘দারুন নাক্কা’ নামক স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
পিতা আব্দুল্লাহর মৃত্যুর ৫ মাস পর প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী সোমবার, ১২ রবিউল আউয়াল ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে সুবেহ সাদেকের সময় কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন।
জন্মের পর প্রথম সাত দিন তিনি নিজ মাতার দুগ্ধ পান করেন। আবু লাহাবের দাসী সুমাইয়ার দুগ্ধ পান করেন ৮দিন। এরপর ধাত্রীমা হালিমা বিনতে আবি জোয়াইব আস সাদিয়ার দুগ্ধ পান করেন ২ বছর। ২ বছরে দুধ ছাড়ার পরই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মুখে কথা ফোটে। ৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি হালিমার ঘরে অবস্থান করেন। হালিমার এক পুত্র আব্দুল্লাহ, তিন কন্যা আনিতা, হুযাইফা ও শাইমার সঙ্গে ৪ বছর অতিবাহিত করেন। ৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ৬ বছর বয়েসে মদীনা থেকে ফেরার পথে “আবওয়া” নামক স্থানে মা আমিনা ইন্তেকাল করেন। এ সময় মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিতার দাসী উম্মে আইমন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের নিকট পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের নিকট তিনি প্রতিপালিত হন। ৭ বছর বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ) কাবা ঘর মেরামতের জন্য পাথর বহন করেন।
৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন বয়সে তাঁর দাদার মৃত্যু হয়। ২৫ বছর বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রথম বিবাহ হয় ৪০ বছর বয়স্কা বিবি খাদিজা (রাঃ) সঙ্গে ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। তখন রাসুল (সাঃ) এর বয়স ছিল ২৫ বছর ১০ দিন। ২৭ রমজান সোমবার, ১লা ফেব্রুয়ারি ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর ১ দিন বয়সে হেরা পর্বত গুহায় মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়ত লাভ করেন। ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর চাচা আবু তালিবের মৃত্যু হয়। এর তিন দিন পরে ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৬৫ বছর বয়সে খাদিজা (রাঃ)এর মৃত্যু হয়।
প্রথম ওহী সুরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত। মিরাজে গমন করেন ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদীনায় হিযরত করেন। মহানবীর প্রথম যুদ্ধ বদর যুদ্ধ ১৪ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে। মহানবীর মক্কা বিজয় ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে। বিদায় হজ্জ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ২৮ সফর বুধবার মহানবী (সাঃ) এর মাথা ব্যাথা ও জ্বর হয়। এ সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর স্থলে আবু বকর (রাঃ) ১৭ ওয়াক্ত নামায পড়ান। ১৪ দিন জ্বরাক্রান্ত থাকার পর ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন, ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার প্রায় দ্বি-প্রহরের সময় মহানবী (সাঃ) ইন্তেকাল করেন। ১৩ রবিউল আউয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর হুজরা খানায় মহানবী (সাঃ)-কে দাফন করা হয়।
মহানবীর সমগ্র জীবনকাল ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘন্টার মত। ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বলতে প্রকৃত পক্ষে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আনুষ্ঠানিকতাকে বুঝায়। প্রতি বছর ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় মহানবী (সাঃ) এর জন্মোৎসব ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালিত হয়। এটি মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম দিবস। কেননা ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মক্কা নগরীর বিখ্যাত কুরাইশ বংশে “মা” আমিনার কোল জুড়ে এ ধরায় আমাদের প্রিয় রাসূল (সাঃ) আগমন করেন। তাই ১২ রবিউল আউয়াল (তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে) নবী কুল শিরোমনির পৃথিবীতে আগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর তথা সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসবের দিন।
রাসূল করিম (সাঃ) এর আগমন মানব জাতির জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এবং বিরাট নিয়ামত। যেমনÑ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন-এ এরশাদ করেনÑ “হে মুহাম্মদ (সাঃ) আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।”
অনুরূপভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের উপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও রহমতের রাসূল (সাঃ) এর আগমনের জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় ও আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। এরই ফলশ্রুতিতে নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হয় ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী।
৬০৪ হিজরী মোতাবেক ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে আরবালাতে সুলতান সালাউদ্দীনের ভগ্নিপতি মালিক মুজ্জাফরউদ্দীন কোকবুরী কর্তৃক সর্বপ্রথম মিলাদুন্নবী উদযাপন শুরু হলেও পরবর্তীতে উলামায়ে কেরামগণের নিকট তা উত্তম কাজ বা বিদয়াতের হাসানাহ রূপে গৃহীত হয় ইসলামের অননুমোদিত কর্মকান্ড পরিহারের শর্তে। কেননা এ উপলক্ষে অনেক সৎ কাজ আনুসাঙ্গিকভাবে সম্পন্ন হয়। এ দিনে করণীয় হলো কুরআন মজীদের তেলাওয়াত, রাসূল করীম (সাঃ) এর বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল জীবন ও তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ আলোচনা করা, তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করা, নবীর জন্ম উপলক্ষে আনন্দিত হওয়া যেমন :- রাসূল করিম (সাঃ) এর শান ও মান সম্পর্কিত কোরআন-এর আয়াত ও সহীহ হাদীসের অর্থ ব্যাখ্যা সহ উপস্থাপন এবং দান খয়রাত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের মধ্যে উত্তম আহার্যের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
তবে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালনে ইসলামী তাহযীব ও তমুদ্দুনের বিপরীত গোমরাহ আনুষ্ঠানিকতা ও কু-সংস্কার সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয় ও নিষেধ। যেমন :- কাবা শরীফ ও রওজায়ে আকসাদের প্রতিকৃতি তৈরি করা কিংবা রাসুল করিম (সাঃ) আগমন করবেন এমন ধারনায় চেয়ার সাজিয়ে রাখাসহ অনৈসলামিক অপসংস্কৃতি।
ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর দিন রাসূল (সাঃ) এ বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল জীবন তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, রাসূল করীম (সাঃ) এর আগমন উপলক্ষে তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করার মাধ্যমে আমাদের প্রতি আল্লাহ তা’য়ালার বিরাট অনুগ্রহ ও নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি। তদুপরি উত্তম আদর্শের শ্রেষ্ঠ প্রতীক রাসূল করিম (সাঃ) এর জীবনের প্রতিটি ঘটনাই মানব কুলের জন্য হেদায়াতের অত্যুজ্জল আলোকবর্তিকা এবং এ সম্পর্কীয় আলোচনা মুমিনের ঈমানী শক্তির উৎস ও উভয় জগতের পরম সৌভাগ্য লাভের উপায়।
এছাড়াও পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ এরশাদ করেছেন- অচীরেই আল্লাহ শোকর আদায়কারীদের উত্তম প্রতিদান দিবেন। তাই ইসলামী তরীকায় যথাযথভাবে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালন করা অত্যাবশ্যক করণীয়। (লেখক: কলামিষ্ট, সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)