ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুখের ভেতরের দাঁতে, মাড়িতে, জিহ্বার বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ভালো দাঁতের যত্ন মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস মুখের ভেতরের অনেক অংশের যেমন-দাঁত ও মাড়িতে ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের মাড়ির রোগ মুখগহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যত্ন নিলে এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরো খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখকে বা মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন-হৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে। ডায়বেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারে তরল, যা মুখকে ভেজা রাখে। মুখের ভেতরের লালা দাঁতের ক্ষয় রোধ করে খাবারের টুকরা ধুয়ে ফেলে, ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধে এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত এসিডের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লালায় খনিজ উপাদান রয়েছে, যা মুখের টিস্যু রক্ষা করতে এবং দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্তক্ষয় বেশি হয়। ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখগহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয় তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে নরম আঠালো ফিল্ম ‘প্লেক’ তৈরি করে। এটি দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয় তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এই সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে।
মাড়ির রোগ: মাড়ির রোগ, যাকে ‘পিরিওডন্টাল গাম ডিজিজ’ও বলা হয়। এটি ডায়াবেটিস সম্পর্কিত মুখের সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় রোগ এবং গুরুতর সমস্যা সৃষ্টিকারী রোগ। চিকিৎসা না করা হলে রোগটি পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়, মাড়ি ফোলা বা রক্ত পড়া অবস্থা থেকে দাঁত পড়ে যাওয়া পর্যন্ত। রক্তে গ্লুকোজের উচ্চ মাত্রা উপস্থিতি মাড়ির রোগ মৃদু থেকে গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন-জিনজিভাইটিস থেকে পিরিওডনটাইটিজ।
জিনজিভাইটিস : মাড়ির রোগের প্রথম পর্যায় হলো মাড়ির প্রদাহ, দাঁতের চারপাশে নরম টিস্যুগুলোর অর্থাৎ মাড়ির একটি হালকা প্রদাহ। মাড়ির কাছে দাঁতে প্লাক এবং টার্টার তৈরি হলে মাড়িতে জ¦ালাপোড়া এবং প্রদাহ সৃষ্টি হলে মাড়ির প্রদাহ হয়। এতে মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যেতে পারে এবং দাঁত ব্রাশের সময় বা শক্ত ফল খাওয়ার সময় রক্তপাত হতে পারে।
পিরিওডনটাইটিস : চিকিৎসা না করা হলে মাড়ির প্রদাহ পিরিয়ডনটাইটিসে অগ্রসর হতে পারে, মাড়ি এবং হাড়ের একটি সংক্রমণ, যা দাঁতকে মাড়ি থেকে আলগা করে রাখে। মাড়ি দাঁত থেকে সরে যেতে থাকে, পকেট তৈরি করে, যা ধীরে ধীরে সংক্রমিত হয়। মুখের ব্যাকটেরিয়া এবং সংক্রমণের ফলে দাঁতকে ধরে রাখে এমন হাড় এবং টিস্যু যেমন-পিরিওডন্টাল মেমব্রেন ও এলভিউলর বোন ভেঙে দিতে শুরু করে। যদি পিরিওডনটাইটিসের চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে দাঁত আলগা হয়ে যেতে পারে এবং এমনকি তুলে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় নিজে থেকেই দাঁত নড়তে নড়তে পড়ে যেতে পারে।
আলসার এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোগ: শুকনা মুখ লালার অভাব, যা মুখের ভেতরে ঘা বা আলসার এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোগের কারণ হতে পারে। এ অবস্থাকে ‘ড্রাই মাউথ’ বলে। অনেক সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও এমনটা হয়। ‘থ্রাশ’ একটি ছত্রাক সংক্রমণ, যা মুখে বেদনাদায়ক, সাদা দাগ সৃষ্টি করে। ‘বানিং মাউথ সিনড্রোম’ মুখের ভেতরে একটি জ¦লন্ত অনুভূতি, যা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রার কারণে হয়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্যের যেকোনো পরিবর্তন সম্পর্কে ডেন্টিস্টকে আপডেট রাখা জরুরি এবং নিয়মিত পরিষ্কার বা স্কেলিং এবং চেকআপের জন্য কত ঘন ঘন আসা উচিত তা জিজ্ঞাসা করাও প্রয়োজন। ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কিভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ অনুসরণ করা প্রয়োজন।
কিভাবে মুখ সুস্থ রাখা যায়?
► রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা প্রয়োজন।
► স্বাস্ব্যকর খাবার এবং পানীয় গ্রহণের ব্যাপারে ডায়েটিশিয়ান যেভাবে আপনার ওজন, উচ্চতা এবং বয়স মেপে খাবার পরিকল্পনা করেছেন, তা অনুসরণ করা ভালো।
► নিয়মিত একজন ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। ► মুখের যত্ন নেওয়ার জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করলে বা দেরি করলে অবস্থা আরো খারাপ করতে পারে।