ঢাকা থেকে শৈলকুপার লক্ষণটিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। এসেই আমিনুল ইসলামের গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটি। ভদ্রলোক পেশায় সূচিশিল্পী ও ফ্যাশন ডিজাইনার। আর নেশায় বাগানবিলাসী। ফটক পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই তাঁর বাগানপ্রেমের পরিচয় পেয়ে যাই। প্রায় ২৫০ গাছে টপিয়ারির অনন্য শিল্পকর্ম দেখে আমরা লা–জবাব হয়ে যাই। ডাল-পাতা ছেঁটে গাছকে নানা রূপ দেওয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে টপিয়ারি। সমকালে টপিয়ারিরীতির এমন সুপরিসর উদ্যান আর চোখে পড়েনি। আমিনুল ইসলাম জানালেন, বিদেশের উদ্যানগুলোয় টপিয়ারির সৌন্দর্য দেখে এর প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছে। নিজের হাতেই কাজটি করেছেন তিনি।
১৫ বিঘা আয়তনের উদ্যান, যার একটি ছোট্ট জায়গাজুড়ে আছে এই টপিয়ারিরীতির গাছপালা। বাকি জায়গায় কী আছে? চলুন ঘুরে ঘুরে দেখা যাক।
বাগানজুড়ে গাছ লাগানোর সময় ছয় ঋতুর বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। যাতে সারা বছরই বাগান আলোকিত করে রাখে কিছু না কিছু ফুল। লেকের পাড়ে সাদা ও রক্তকাঞ্চনের কালার লাইন সে কথাই প্রমাণ করে। বীথিবদ্ধ, পত্রহীন কাঞ্চনের ডালপালা ভরা ফুলগুলো আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে নিয়ে গেল। একটি লাল, একটি সাদা—এভাবে পরিকল্পিতভাবে গাছগুলো লাগানো হয়েছে। বসন্তের এই পুষ্পসম্ভার অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ে। কাঞ্চনের মহোৎসব শেষ হতে না হতেই চৈত্র-বৈশাখের অন্য ফুল ফোটার প্রস্তুতি শুরু হয়। আমিনুলের বাগানের এটাই বিশেষত্ব। সারা বছর এখানে কিছু না কিছু ফুল-ফল থাকে। এই উদ্যানে লতানো উদ্ভিদগুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে আছে মাধবী, মালতী, নীলমণি, সাদামণি, ক্যাটস ক্ল ভাইন, রসুন্দি, কুশমিকা, সোনাঝুরি লতা, ব্লিডিং হার্ট, চিমাইন, হানিসাকল, অনন্তলতা, ইয়েলো ট্রাম্পেট ভাইন, নীলবনলতা, মধুমঞ্জরি, গোল্ডেন ফিঙ্গার ইত্যাদি।
রাজঅশোকছবি: লেখক
উদ্যানে মাত্র ১২ বছরে ৫০০ প্রজাতির প্রায় ১০ হাজার উদ্ভিদের সমাবেশ ঘটিয়েছেন আমিনুল ইসলাম। নার্সারি ঘুরে ঘুরে উদ্ভিদ সংগ্রহ তাঁর নেশা। মাস বা সপ্তাহান্তে গাছগুলো নিয়ে আসেন। তারপর মহোৎসাহে গাছগুলো লাগানো হয়। আয়তনের তুলনায় বাগানটিতে গাছের ঘনত্ব অনেক বেশি। কিন্তু প্রতিটি গাছই তাঁকে এমন মায়ার বাঁধনে জড়িয়েছে যে কোন গাছ রেখে কোন গাছ সরাবেন মনস্থির করতে পারেন না। এই সংগ্রহশালায় এমন সব দুর্লভ উদ্ভিদ রয়েছে যে বাছাই করে বাদ দেওয়াটা আসলেই দুরূহ। এমন সব উদ্ভিদের কথাও বলা যায়, যা সারা দেশে আছেই একেবারে হাতে গোনা। যেমন রনডেলেশিয়া, রাজ অশোক, ক্যামেলিয়া, কনকচাঁপা, ক্যাশিয়া ব্যাকেরিয়ানা, হলুদ পলাশ, শ্বেতচন্দন, জহুরিচাঁপা, মণিমালা, অঞ্জন, পালাম, ট্যাবেবুইয়া, কাইজেলিয়া, ম্যাক্সিকান ফ্লেম, সুরভি বা ওসমান্থাস ইত্যাদি। এসব ফুল সারা দেশে সংখ্যায় এতই কম যে হিসাব করে সংখ্যাটা বলে দেওয়া যায়। বছর কয়েক আগে রমনা পার্কে রনডেলেশিয়ার একমাত্র গাছটি বিলুপ্ত হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে একটি গাছ দেখেছি। সংখ্যার বিচারে যা একেবারেই নগণ্য।
আমিনুলের এই বৃক্ষভান্ডারে দেশি প্রজাতির অনেক অপ্রচলিত উদ্ভিদও স্থান পেয়েছে। যেগুলো এখন সংখ্যায় অনেক কম। এই তালিকাও অনেক দীর্ঘ। নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, চিকরাশি, তেলশুর, কানাইডিঙ্গা, সুলতানচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, মহুয়া, হাড়গজা, কাউফল, বৈলাম, উদাল, রিঠা, সিভিট, বুদ্ধ নারকেল, জংলি বাদাম, কইনার, মুচকুন্দ, রক্তন ইত্যাদি। নমুনা হিসেবে কিছু বিদেশি ফলও রোপণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো রাম্বুটান, পিচ, আলুবোখারা, ব্রেডফ্রুট, অ্যাভোকাডো, ওয়ালনাট, লংগান, মরু খেজুর, নাসপাতি, জাবাটিকাবা, কোকো, পিনাট বাটার, ক্যাট ফ্রুট, এগ ফ্রুট, চিয়াং, ম্যানিলা চেরি ইত্যাদি।
এই গাছবাড়ির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে গাছের কথা, ফুলের কথা, তাদের আনন্দ ও উৎসবের কথা। এখানে কান পাতলে শোনা যায় একজন বৃক্ষবন্ধু-বৃক্ষদরদি মানুষের প্রাণের স্পন্দন। ১৫ বিঘার এই শান্তিকুঞ্জতে বাঁধা পড়েছে যাঁর অন্তরাত্মা।
এ ছাড়া বাগানে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে কিছু পাম। এর মধ্যে পান্ডানাস ইউটিলিস অনেকটাই ব্যতিক্রম। আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লালপাতা, ক্যাকটাস, মরু গোলাপ, পাতাবাহার—এসব গাছের বীথিবদ্ধ বিন্যাস বাগানের সৌন্দর্যকে আরও নান্দনিক করেছে। বাগানের এই সৌন্দর্যসুধা পান করতেই ঢাকা থেকে দিনকয়েক পরপর ছুটে আসেন আমিনুল। জীবিকার কাজটুকুর বাইরে এখন গাছই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। পাশাপাশি এই বাগানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে দুবেলা পাখিদেরও খাবার দেওয়া হয়। সময় হলেই দল বেঁধে চলে আসে পাখিগুলো। এমন মধুর দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়।
ছেলেবেলায় বাবার কৃষিকাজে সাহায্য করেছেন আমিনুল। বাড়ির উঠানে ফুলের বাগান করতেন মা। মায়ের উদ্ভিদপ্রীতি আর বাবার কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা—এই দুই প্রভাব থেকেই বৃক্ষপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে মনে করেন তিনি। উদ্ভিদের সঙ্গে আমিনুল ইসলামের সখ্য আরও গভীর হোক, এই প্রত্যাশা।